Summary
এক সময় আরব দেশে তিনজন লোক ছিল: একজন ধবল, একজন টাক, এবং একজন অন্ধ। আল্লাহ তাদের পরীক্ষা করার জন্য এক ফেরেশতা পাঠালেন।
ফেরেশতা ধবল লোকের কাছে এসে তার গায়ের রং সুন্দর করার জন্য হাত রাখলেন এবং তাকে একটি গাভি দিলেন। এরপর টাকওয়ালার কাছে যেয়ে তার মাথায় চুল উঠানোর পর তাকে গাভি দিলেন। অন্ধের কাছে গিয়ে তার চোখে হাত রেখে তাকে চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলেন এবং একটি ছাগল দিলেন।
কিছু দিন পর ফেরেশতা তাদের কাছে মানুষের রূপে ফিরে আসেন, একজন বিদেশি হয়ে। ধবল রোগী যিনি তার গায়ের রং এবং ধনসম্পদ পেয়েছিলেন, ফিরতি সময়ে উট দিতে অস্বীকার করেন। টাকওয়ালাও গাভি দিতে অক্ষম হন। কিন্তু অন্ধ লোক যিনি আল্লাহর সাহায্য পেয়েছিলেন, তিনি দান করতে রাজি হন।
ফেরেশতা বলেন যে এভাবেই তাদের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহ সামর্থ্যবানদের উপর সন্তুষ্ট এবং মিথ্যাবাদীদের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
সেকালে আরব দেশে তিনটি লোক ছিল- একজনের সর্বাঙ্গে ধবল, একজনের মাথায় টাক, আরেকজনের দুই চোখ অন্ধ। আল্লাহ তাহাদের পরীক্ষার জন্য এক ফেরেশতা পাঠাইলেন। ফেরেশতা হইলেন আল্লাহর দূত। তাহারা নূরের তৈয়ারী। এমনি কেহ তাহাদিগকে দেখিতে পায় না। আল্লাহর হুকুমে তাহারা সকল কাজ করিয়া থাকেন।
ফেরেশতা মানুষের রূপ ধরিয়া প্রথমে ধবলরোগীর নিকটে আসিলেন। তিনি তাহাকে বলিলেন, কী তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো?
ধবলরোগী বলিল, আহা! আমার গায়ের রং যদি ভালো হয়। সকলে যে আমাকে বড় ঘৃণা করে।
স্বর্গীয় দূত তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া দিলেন। তাহার রোগ সারিয়া গেল। তাহার গায়ের চামড়া ভালো হইল।
তারপর আল্লাহর দূত পুনরায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, এখন তুমি কী চাও?
সে বলিল, আমি উট চাই।
দূত তাহাকে একটি গাভিন উট দিয়া বলিলেন, এই লও। ইহাতে তোমার ভাগ্য খুলিবে। তারপর সেই ফেরেশতা টাকওয়ালার কাছে গিয়া বলিলেন, কী তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো?
সে বলিল, আহা! আমার এই রোগ যদি সারিয়া যায়। যদি আমার মাথায় চুল উঠে!
আল্লাহর দূত তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া দিলেন। তাহার টাক সারিয়া গেল। তাহার মাথায় চুল গজাইল। দূত পুনরায় বলিলেন, এখন তুমি কী চাও?
সে বলিল, গাভি।
তিনি তাহাকে একটি গাভিন গাই দিয়া বলিলেন, এই লও। ইহাতে তোমার ভাগ্য খুলিবে।
তারপর স্বর্গীয় দূত অন্ধের কাছে গেলেন। গিয়া বলিলেন, কী তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো?
সে বলিল, আল্লাহ্ আমার চোখ ভালো করিয়া দিন। আমি যেন লোকের মুখ দেখিতে পাই।
স্বর্গীয় দূত তাহার চোখে হাত বুলাইয়া দিলেন। তাহার চোখ ভালো হইয়া গেল।
তারপর তিনি তাহাকে বলিলেন, এখন তুমি কী চাও?
সে বলিল, আমি ছাগল চাই।
স্বর্গীয় দূত তাহাকে একটি গাভিন ছাগল দিয়া বলিলেন, এই লও। ইহাতে তোমার ভাগ্য খুলিবে।
তারপর উটের বাচ্চা হইল, গাভির বাছুর হইল, ছাগলের ছানা হইল। এই রকম করিয়া উটে, গাভিতে, ছাগলে তাহাদের মাঠ বোঝাই হইয়া গেল।
কিছুদিন পর আবার সেই ফেরেশতা পূর্বের মতো মানুষের রূপ ধরিয়া, সেই যে আগের ধবলরোগী ছিল, তাহার নিকট উপস্থিত হইলেন।
সেখানে গিয়া তিনি বলিলেন, আমি এক বিদেশি। বিদেশে আসিয়া আমার সব পুঁজি ফুরাইয়া গিয়াছে। এখন আল্লাহর দয়া ছাড়া আমার আর দেশে ফিরিবার উপায় নাই। যিনি তোমারে সুন্দর গায়ের রং দিয়াছেন, সুন্দর চামড়া দিয়াছেন, আর এত ধনদৌলত দিয়াছেন, তাঁহার দোহাই দিয়া তোমার কাছে একটি উট চাহিতেছি।
সে বলিল, উটের অনেক দাম, কী করিয়া দিই?
স্বর্গীয় দূত বলিলেন, ওহে! আমি যেন তোমাকে চিনিতে পারিতেছি। তুমি না ধবলরোগী ছিলে, আর সকলে তোমাকে ঘৃণা করিত? তুমি না গরিব ছিলে, পরে আল্লাহ তোমাকে ধনদৌলত দিয়াছেন?
সে বলিল, না, তা কেন? এসব তো আমার বরাবরই আছে।
স্বর্গীয় দূত বলিলেন, আচ্ছা! যদি তুমি মিথ্যা বলিয়া থাক, তবে তুমি যেমন ছিলে আল্লাহ আবার তোমাকে তাহাই করিবেন।
তারপর স্বর্গীয় দূত পূর্বে যে টাকওয়ালা ছিল, তাহার কাছে গেলেন। সেখানে গিয়া আগের মতো একটি গাভি চাহিলেন। সেও ধবলরোগীর মতো তাহাকে কিছুই দিল না। তখন স্বর্গীয় দূত বলিলেন, আচ্ছা, যদি তুমি মিথ্যা কথা বলিয়া থাক, তবে যেমন ছিলে আল্লাহ তোমাকে আবার তেমনি করিবেন।
তারপর স্বর্গীয় দূত পূর্বে যে অন্ধ ছিল, তাহার কাছে গিয়া বলিলেন, আমি এক বিদেশি। বিদেশে আমার সম্বল ফুরাইয়া গিয়াছে। এখন আল্লাহর দয়া ছাড়া আমার দেশে পৌঁছিবার আর কোনো উপায় নাই। যিনি তোমার চক্ষু ভালো করিয়া দিয়াছেন, আমি তোমাকে সেই আল্লাহর দোহাই দিয়া একটি ছাগল চাহিতেছি; যেন আমি সেই ছাগল-বেচা টাকা দিয়া দেশে ফিরিয়া যাইতে পারি।
তখন সে বলিল, হ্যাঁ ঠিক তো। আমি অন্ধ ছিলাম, পরে আল্লাহ আমাকে দেখিবার ক্ষমতা দিয়াছেন। আমি গরিব ছিলাম, তিনি আমাকে আমির করিয়াছেন। তুমি যাহা চাও লও। আল্লাহর কসম, আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে জিনিস লইতে তোমার মন চায়, তাহা যদি তুমি না লও, তবে আমি তোমাকে কিছুতেই ভালো লোক বলিব না।
ফেরেশতা তখন বলিলেন, বাস্। তোমার জিনিস তোমারই থাক। তোমাদের পরীক্ষা লওয়া হইল। আল্লাহ তোমার উপর খুশি হইয়াছেন, আর তাহাদের উপর বেজার হইয়াছেন।
# বহুনির্বাচনী প্রশ্ন
ধবল - সাদা। শ্বেত। এক প্রকার চর্মরোগ- এই রোগে শরীরে চামড়া ও চুল সাদা হয়ে যায়।
গাভিন - গর্ভধারণ করেছে এমন (গাভিন গরু)।
আমির - ধনী। ধনবান।
সর্বাঙ্গে - (সর্ব+অঙ্গ> সর্বাঙ্গ+ এ বিভক্তি) সারা শরীরে। সমস্ত দেহে।
কসম - শপথ। দিব্যি।
স্বর্গীয় দূত - আল্লাহর বার্তা বাহক। সংবাদবাহক।
নূর - জ্যোতি। আলো।
পুঁজি - সম্বল। মূলধন।
দোহাই - শপথ। কসম।
সম্বল - পাথেয়। পুঁজি।
বেজার - অখুশি। অসন্তুষ্ট।
সাধুরীতিতে রচিত এই গল্পে হাদিসের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এই গল্পের মূল বাণী হচ্ছে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন এবং সৎলোককে যথাযথ পুরস্কার দেন।
আরব দেশের তিন জন লোককে পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহ একজন ফেরেশতা পাঠান। এদের একজন ধবলরোগী একজন টাকওয়ালা এবং আরেকজন অন্ধ।
ফেরেশতার অনুগ্রহে এই তিন জনেরই শারীরিক ত্রুটি দূর হলো। তিন জনই সুন্দর সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের চেহারা পেল। শুধু তাই নয়, ফেরেশতার কৃপায় প্রথম জন একটি উট থেকে বহু উটের, দ্বিতীয় জন একটি গাভি থেকে বহু গাভির এবং তৃতীয় জন একটি ছাগল থেকে বহু ছাগলের মালিক হয়ে গেল।
কিছুদিন পর এদের পরীক্ষা করার জন্য ফেরেশতা গরিব বিদেশির ছদ্মবেশে এদের কাছে হাজির হলেন। তিনি একেক জনের কাছে গিয়ে তাদের আগের দুরবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে কিছু সাহায্য করতে বললেন। প্রথম দুজন তাদের আগের অবস্থার কথা অস্বীকার করে ছদ্মবেশী ফেরেশতাকে খালি হাতে বিদায় দিল। অন্যদিকে তৃতীয় জন নির্দ্বিধায় ফেরেশতার ইচ্ছেমতো সবকিছু দিতে রাজি হল। আল্লাহ তার উপর খুশি হলেন এবং তার সম্পদ তারই রয়ে গেল। প্রথম দুজনের উপর আল্লাহ অসন্তুষ্ট হলেন এবং তাদের অবস্থা আগের মতো হয়ে গেল। অকৃতজ্ঞরা তাদের অকৃতজ্ঞতার উপযুক্ত ফল পেল।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জন্ম ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার পেয়ারা গ্রামে। তিনি বহুভাষাবিদ ও পণ্ডিত হিসেবে খ্যাত। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে বিএ অনার্স ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে এমএ পাস করেন। তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের প্রথম ছাত্র। পরে তিনি প্যারিসের সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব লিটারেচার ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় তিনি অসাধারণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন। বাংলা ব্যাকরণ রচনাতেও তাঁর অবদান স্মরণীয়।
কর্মজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। ছোটদের জন্য তাঁর লেখা রচনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- 'শেষ নবীর সন্ধানে' ও 'গল্প মঞ্জুরী'। তাঁর সম্পাদনায় শিশু-পত্রিকা 'আঙুর' প্রকাশিত হয়। 'বাংলা ভাষার আঞ্চলিক অভিধান' সম্পাদনা তাঁর অসামান্য কীর্তি।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল প্রাঙ্গণে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
Read more